বলা হয়ে থাকে, আগের দিনে স্কুল ঘর ছিল কাঁচা আর শিক্ষকগণ ছিলেন পাঁকা। আর এখন স্কুল ঘর হয়েছে পাঁকা আর শিক্ষকগণ কাঁচা। আমরা মনে করি, এসএসসি যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকগণ অবশ্যই মেধাবী। মেধার স্বাক্ষর রেখেই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন। অপরদিকে তাঁরা তুলনামূলকভাবে পেশার প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। শিক্ষক হিসেবে পাঁকা।

সম্প্রতি নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলায় এসএসসি যোগ্যতা সম্পন্ন এবং পদোন্নতি নিতে অনিচ্ছুক সহকারী শিক্ষকদের পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)’র সুপারিশের ভিত্তিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক আদেশে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু বিধিমালা কী বলে?

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ১৯৯১, ২০১৩ ও ২০১৯ এর তপসিল পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ১৯৯১ নিয়োগবিধিতে সহকারী শিক্ষক পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে “ পুরুষ প্রার্থীর ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট অথবা কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হইতে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রী। মহিলা প্রার্থীর ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট অথবা কোন স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হইতে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রী অথবা মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় ২য় বিভাগে উত্তীর্ণ। ১৯৯১ নিয়োগ বিধিতে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারি শিক্ষক পদে ৭ বছরের অভিজ্ঞতা এবং এসএসসি যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের ক্ষেত্রে হাইয়ার সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (সিইনএড) প্রশিক্ষণ থাকিতে হইবে”।

২০১৩ নিয়োগবিধিতে সহকারী শিক্ষক পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে পুরুষ প্রার্থীর ক্ষেত্রে, “দ্বিতীয় শ্রেণি বা সমমানের জিপিএসহ স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রী। মহিলা প্রার্থীর ক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষায় ন্যুনতম দ্বিতীয় বিভাগ / সমমানের জিপিএসহ উত্তীর্ণ । ২০১৩ নিয়োগবিধিতে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, সহকারী শিক্ষক পদে ৭ বছরের অভিজ্ঞতা এবং উচ্চ মাধ্যমিকসার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সহকারী শিক্ষকের ক্ষেত্রে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন (সিইনএড) /ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন (ডিপিএড) প্রশিক্ষণ থাকিতে হইবে”।

২০১৯ নিয়োগবিধিতে সহকারী শিক্ষক পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে, “দ্বিতীয় শ্রেণি বা সমমানের সিজিপিএসসহ স্নাতক বা স্নাতক সম্মান বা সমমানের ডিগ্রী। প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে সহকারি শিক্ষক পদে প্রশিক্ষণসহ ৭ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে”। ২০১৯ নিয়োগবিধিতে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। এখানে শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা উল্লেখ না করা মানে কী ১৯৯১ নিয়োগবিধি বা তৎপূর্বের নিয়োগবিধিতে সহকারী শিক্ষক পদে ন্যুনতম যে শিক্ষাগত যোগ্যতা (এসএসসি) চাওয়া হয়েছে, সেই শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্থাৎ এসএসসি বুঝানো হয়েছে? না। বরং আমরা মনে করি, ২০১৯ নিয়োগবিধিতে সহকারী শিক্ষক পদে ন্যুনতম যে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছে প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রেও সেই শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ ৭ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে।

কিন্তু যেহেতু ২০১৯ নিয়োগ বিধি অনুযায়ী অদ্যাবধি কোনো নিয়োগ সম্পন্ন হয়নি সেহেতু ২০১৩ নিয়োগবিধি অনুসরণ করে পদোন্নতির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত বলে মনে করি। ২০১৩ নিয়োগবিধি অনুসরণ করে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে সারাদেশে ১৮ হাজার সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন জ্যেষ্ঠতার তালিকায় এসএসসি যোগ্যতা সম্পন্নদের যোগ্যতাবিহীন হিসেবে উল্লেখ করে তাদেরকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আবার এসএসসি যোগ্যতা সম্পন্ন ও পদোন্নতি নিতে অনিচ্ছুক সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়ার ফলে পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছে চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকগণ। তাছাড়া ২০১৪ সালের ৯ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদটিকে ২য় শ্রেণির ঘোষণা দিয়েছেন। পিএসসি’র সুপারিশপ্রাপ্ত বিসিএস (নন ক্যাডার) অনেক শিক্ষক ইতোমধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেছেন। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। এমতাবস্থায় ২০১৩ বা ২০১৯ নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে বা ভুল ব্যাখ্যা করে এসএসসি যোগ্যতা সম্পন্নদের এবং পদোন্নতি নিতে অনিচ্ছুক সহকারী শিক্ষকদের কেনো প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। একজন শিক্ষক বিভিন্ন কারনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিতে অনিচ্চছুক থাকতেই পারেন। কিন্তু দায়িত্ব নিতে অনিচ্চছুক শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? আমরা মনে করি, এতে প্রাথমিক শিক্ষা ও সরকারের সফলতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সারাদেশের শিক্ষকদের মাঝে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

মুহাম্মদ রবিউল হোছাইন

প্রধান শিক্ষক (চলতি দায়িত্ব)

কায়দাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

মহেশখালী, কক্সবাজার।

০১৭১৩৬১৪৭১৮